► টার্গেট ছিল সরকারের শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিদের বাসভবন ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা
► ‘কমল প্রভা’র মালিকের পাইলট ছেলেসহ গ্রেপ্তার ৪
► প্রত্যাহারের পরও দায়িত্বে বহাল হন সন্দেহভাজন পাইলট

কালেরকন্ঠ :
রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার আগে ও পরে উড়োজাহাজ নিয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এবং সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বাসভবনে হামলার পরিকল্পনা করেছিল জেএমবির জঙ্গিরা। র্যাব জানিয়েছে, নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা সরোয়ার জাহান মানিক এবং র্যাবের অভিযানে নিহত জঙ্গি মীর আকরাবুল করিম আব্দুল্লাহর সঙ্গে মিলে ওই পরিকল্পনা করেছিলেন বাংলাদেশ বিমানের পাইলট সাব্বির এমাম।

সাব্বির রাজধানীর দারুস সালামের বর্ধনবাড়ি এলাকার আলোচিত ভবন কমল প্রভার মালিকের ছেলে। ওই বাড়িতেই র্যাবের অভিযানে নিহত হন জঙ্গি আব্দুল্লাহ।
র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, গত মাসে সাব্বিরের বাবা হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। গত ২৬ অক্টোবর নারায়ণঞ্জের ফতুল্লা থেকে আব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সহযোগী বিল্লাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তিনিও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দির তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব -৪-এর একটি দল গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিরা হলেন সাব্বির এমাম (৩১), তাঁর মা মোসা. সুলতানা পারভীন (৫৫), পারভীনের ভাইয়ের ছেলে আসিফুর রহমান আসিফ (২৫) এবং কমল প্রভার পাশের চায়ের দোকানদার মো. আলম (৩০)।

র্যাব কর্মকর্তারা জানান, নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা সরোয়ার জাহান মানিক কমল প্রভায় গিয়ে বৈঠক করেন। সেখানে সরোয়ারের কাছেই আদর্শ গ্রহণ করে জঙ্গি হন বাড়ির মালিক হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদ, স্ত্রী সুলতানা পারভীন, ছেলে সাব্বির এমাম, আত্মীয় আসিফুর রহমান আসিফ।

বাড়ির মালিক আজাদ ও তাঁর স্ত্রী জঙ্গি তত্পরতায় আব্দুল্লাহকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেন। ছেলে সাব্বির বাংলাদেশ বিমানের ফার্স্ট অফিসার বা পাইলট হিসেবে কর্মরত। তিনি সরোয়ার ও আব্দুল্লাহর সঙ্গে মিলে বিমানের ফ্লাইট চালিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বাসভবনে আঘাত করা অথবা বিমানের যাত্রীদের জিম্মি করে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। এমনকি ছুটি না নেওয়ার বদলে পাওয়া বিশেষ ভাতার ১০ লাখ টাকাও আব্দুল্লাহর মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনে দান করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের আরেক সহযোগী মো. আলম ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মতো ট্রাক নিয়ে পুলিশের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন। এসব হামলা চালানোর জন্যই কমল প্রভায় বিস্ফোরক মজুদ করেছিল জঙ্গিরা। কয়েকজনকে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। বিমান নিয়ে হামলার প্রশিক্ষণ দেওয়ারও কথা ছিল।
র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, দুই আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব স্পর্শকাতর তথ্য মিলেছে। পরবর্তী তদন্তে এগুলো খতিয়ে দেখা হবে। সাব্বিরের বাড়িতে অভিযানের সময় প্রাথমিক তথ্য পেয়ে বিমান কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল র্যাব। ওই সময় তাঁকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হলেও পরে তিনি আবার দায়িত্বে বহাল হন। সর্বশেষ গত সোমবারও সাব্বির ঢাকা-কলকাতা রুটে দায়িত্ব পালন করেন।

এ ব্যাপারে জানতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মোসাদ্দেক আহমেদ ও মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) শাকিল মেরাজের মোবাইল ফোন নম্বরে অনেকবার কল করা হলেও তাঁরা ফোন ধরেননি। তবে গত ৭ সেপ্টেম্বর শাকিল মেরাজ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন যে সাব্বিরকে দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হয়েছে।

গতকাল বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘পাইলট সাব্বির জঙ্গি নেতা সরোয়ার জাহান মানিক ও আব্দুল্লাহর সঙ্গে পরিকল্পনা করে উড্ডয়নরত বিমান দখলে নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বাসভবনে হামলার পরিকল্পনা করেছিল। তারা মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে অবতরণেরও পরিকল্পনা করেছিল। র্যাবের তত্পরতায় এসব পরিকল্পনা সফল হয়নি। আব্দুল্লাহকে তিনি (সাব্বির) বলেছিলেন যে জঙ্গিদের এ হামলার ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। বিল্লাল রেকিও করেছিল। কমলপ্রভায় যেসব বিস্ফোরক পাওয়া যায় সেগুলো এসব হামলায় ব্যবহারের জন্য জঙ্গিরা জড়ো করে। ’ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘এসব তথ্য প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তবে আমরা সাব্বিরের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য পেয়েছি। আসামিদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে পরবর্তী সময়ে আরো তথ্য জানার চেষ্টা করা হবে। ’

মুফতি মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কমলপ্রভায় অভিযানের পর পাইলট সাব্বিরকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যহার করা হলেও পরে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ সোমবার রাতেও তিনি কলকাতা-ঢাকা রুটে ফ্লাই (সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিট থেকে রাত ১১টা) করেন। ’

গত ৪ সেপ্টেম্বর রাতে টাঙ্গাইলে ড্রোনসহ দুই সহোদরকে গ্রেপ্তারের সূত্র ধরে রাজধানীর দারুস সালামের বর্ধন বাড়ির ২/৩-বি নম্বর বাড়ি কমলপ্রভায় জঙ্গি আস্তানা শনাক্ত করেছিল র্যাব। সেখানে ছিল জঙ্গি আব্দুল্লাহ, তার দুই স্ত্রী নাসরিন ও ফাতেমা, দুই ছেলে ওসামা ও ওমর এবং দুই কর্মচারী। ৫ সেপ্টেম্বর ভোরে বাড়ির ২৩টি ফ্ল্যাট থেকে ৬৫ বাসিন্দাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর মোবাইল ফোনে আব্দুল্লাহকে আত্মসমর্পণের অনুরোধ করে র্যাব। ৫ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে আত্মসমর্পণে রাজি হয় আব্দুল্লাহ। তবে আত্মসমর্পণ না করে রাত পৌনে ১০টার দিকে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায় সে। এতেই সাতজন মারা যায়। ৬ সেপ্টেম্বর তাদের পুড়ে যাওয়া দেহাবশেষ উদ্ধার করে র্যাব। এরপর অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করে ৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেন র্যাব কর্মকর্তারা। ওই ঘটনার পর বাড়ির মালিক আজাদ ও নৈশপ্রহরী সিরাজুল ইসলামসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।

র্যাবের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, গ্রেপ্তারকৃত সাব্বির এনাম ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি থেকে বিমান চালনার প্রশিক্ষণ নেন। এরপর তিনি ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রিজেন্ট এয়ারওয়েজে চাকরি করেন। ওই সময় স্পেন থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ২০১৪ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশ বিমানের পাইলট হিসেবে কর্মরত। তিনি বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং-৭৩৭ পরিচালনা করেন। সাব্বির তুরস্ক থেকেও বিমান চালনার ওপর প্রশিক্ষণ নেন। তিনি দুবাই, কাতার, মাসকাট, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ছাড়াও আরো অনেক দেশে বাংলাদেশ বিমানের পাইলট হিসেবে কাজ করেছেন। আব্দুল্লাহর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল এবং সরোয়ার জাহান মানিকের কাছে থেকে ‘বায়াত’ গ্রহণ করেন।

মুফতি মাহমুদ আরো বলেন, সরোয়ার ও আব্দুল্লাহর সঙ্গে রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তিদের বাড়িতে বিমান হামলার পরিকল্পনার পর জঙ্গিদের সঙ্গে সাব্বিরের যোগাযোগ ছিল। আব্দুল্লাহকে তিনি বিমানের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারেও বলেছেন। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব পরিকল্পনার কথা স্বীকার করেন সাব্বির। মুফতি মাহমুদ বলেন, ‘সাব্বিরের মতো একজন দুর্ধর্ষ ব্যক্তি বাংলাদেশ বিমানের মতো সংবেদনশীল স্থানে চাকরিরত, যেখানে সর্বদা বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যাতায়াত। এ ধরনের একজন উগ্রবাদী জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব বাংলাদেশকে নিকট ভবিষ্যতে আরো একটি নতুন অনাকাঙ্ক্ষিত-ভয়াবহ ঘটনা থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। আগামী দিনে এ ধরনের সফলতা ধরে রাখতে র্যাব বদ্ধপরিকর। ’

এই র্যাব কর্মকর্তা আরো বলেন, চায়ের দোকানদার আলম বিভিন্ন সময় আব্দুল্লাহকে গাড়ি সরবরাহ করত। গত রমজানের আগে আলমের মাধ্যমে ট্রাক সংগ্রহ করে নিকটবর্তী পুলিশি স্থাপনায় নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল আব্দুল্লাহ। বিল্লালের সেই ট্রাক চালানোর কথা ছিল। সম্প্রতি ইউরোপে জঙ্গিদের গাড়ি হামলার কৌশলে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রেপ্তারকৃত আলমের সরবরাহকৃত গাড়ি দিয়ে সংগঠনের অন্য সদস্যরা গাড়ি চালানোর অনুশীলন করে।

র্যাব কর্মকর্তারা জানান, সাব্বিরের মা সুলতানা পারভিনও আব্দুল্লাহর বাসায় গিয়ে সরোয়ারের মাধ্যমে বায়াত গ্রহণ করেন। তিনি জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সহায়তা করে আসছিলেন। পারভীনের ভাই আলমগীর হোসেনের ছেলে আসিফও আব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠ ছিল। তাদের বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপা থানায়। আসিফও একইভাবে বায়াত নিয়ে বিস্ফোরক তৈরির জন্য কেমিক্যাল সরবরাহ করত। তার বন্ধুর কাছ থেকে একটি ৯ এমএম পিস্তল এনে সে আব্দুল্লাহকে দিতে চায়। তবে দাম বেশি হওয়ায় পরে অস্ত্রটি কেনা হয়নি।

র্যাব কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তারকৃত চারজনকে আজ বুধবার ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হবে।